পূর্বকালে মাদারীপুর একটি গ্রাম ও একটি পরগনার নাম ছিলো। জালালপুর ও কাশিমপুর পরগনার কিছু অংশ নিয়ে মাদারীপুর পরগনার উদ্ভব হয়। ব্রিটিশ সরকারের খাতায় এট ছিলো ফরিদপুর জেলার ১০ নং পরগণা। যার আয়তন ছিলো ১২.২৪ স্কোয়ার মাইল। ১৭৮০ সালের ২০ জুলাই তারিখে প্রকাশিত রেনেলকৃত মানচিত্রে সর্বপ্রথম ‘মাদারীপুর’ নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। তারও পূর্বে এ জনপদের নাম ছিলো ‘মুলফৎগঞ্জ’ মতান্তরে ‘মলফতগঞ্জ’।৭
পঞ্চদশ শতাব্দীর সূফী সাধক হযরত সৈয়দ বদিউদ্দিন জিন্দা শাহমাদার (রঃ) এর নামানুসারে ‘মাদারীপুর’ নামকরণ করা হয়। অন্য একটি কথিত প্রকৃতি ভিত্তিক তথ্য পাওয়া যায়; এতদাঞ্চলে একদা প্রচুর পরিমাণে শিমূল গাছ শোভা পেতো। আঞ্চলিক ভাবে শিমূলকে বলা হয় মান্দার। এই মান্দার গাছের অধিক্য হেতুই এলাকার নাম হয় মাদারীপুর। উচ্চারণ পরম্পরায় মান্দারীপুর>মাঁদারীপুর>মাদারীপুর।৮
এলাকার শাহমাদার অপভ্রংশে শামান্দার নামেও পরিচিত ছিলেন।৯ শহরের উপকন্ঠে তাঁর দরগা শরীফ রয়েছে। সূদুর অতীতে ফরিদপুরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে জঙ্গলাকীর্ণ এবং জলদ্বারা বেষ্টিত দুর্গমপ্রায় কুলপদ্দী (পদ্মার কূল> কূলপদ্মী—বর্ন বিপর্যয়ে সাধিত অপভ্রষ্ট কূলপদ্দী) এলাকায় মাদারী সম্প্রদায় আস্তানা গড়ে তোলে। এই আস্তানাকে ঘিরে এতদাঞ্চলে প্রথম একটি আস্তানা গড়ে ওঠে। সেই বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে একটি জনপদ এবং তখন এই সূফী তরিকার নামে এই আস্তানা কেন্দ্রিক লোকালয়টির নাম রাখা হয় মাদারীপুর।
❝পড়ুন — মাদারীপুর জেলার ভৌগোলিক বিবরণ ❞
মাদারী ফকিরগণ অবধূত সন্যাসীদের মতো লম্বা চুল রাখতো, শরীরে ভষ্ম মাখতো, হাত ও গলায় লোহার শেকল পরতো এবং কালো পাগড়ি ও কালো পতাকা ধারণ করতো। তারা সর্বদা আগুন জ্বালিয়ে বসতো এবং ভাং ও গাঁজা খেতো। সাধনায় সিদ্ধ ফকিরগণ প্রায় নগ্ন থাকতেন এবং এই অবস্থায় প্রচন্ড শীতের মধ্যেও ঘুরে বেড়াতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক লোক শাহমাদারকে ভক্তি করতো। মাদার শাহের আস্তানায় হিন্দুদেরকেই বেশি ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে দেখা যেতো। শহরের হিন্দু ব্যবসায়ীরা দোকানে সন্ধারতির সময় ধ্রুপদীপ প্রদান কালে শাহমাদারের নাম উচ্চারণ করতো।১০
আরেকটি বর্ননা মতে মাদারীপুরের দরগাখোলা শাহমাদারের মাজার নয়। তার শুভ পদধূলিও পড়েনি এখানে; তাঁকে নিয়ে এদেশে যা কিছু কাহিনী তা কিংবদন্তি লোকশ্রুতি।...তবুও দরগা খোলার কুঠুরি দু'টিকে কেন্দ্র করে যে দু'টি বিরাট অটবি দাঁড়িয়ে আছে তা যেনো মানবতাবাদী মাদারী পীরের মহাত্ম, মহানুভবতা এবং শাশ্বতবানী ঘোষণা করছে যুগযুগান্তর প্রাকৃতিক সুউচ্চ সৌধরূপে।...
একদিন চৈত্র সংক্রান্তির গলৈয়া ও রথের মেলা বসতো এখানে; হাজার হাজার হিন্দু মুসলমান পুন্যার্থী আবালবৃদ্ধবনিতার কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে উঠতো দরগাঙ্গন। রথের মেলায় পুন্যার্থীরা হাঁড়ি টেনে প্রাপ্তির খাতায় কী সঞ্চয় করতো জানি না, কিন্তু কিছু ভাব, কিছু ভাষা, কিছু অকথিত কথা পেতো বোধ হয় শাহমাদারের কাছে, যা অসাম্প্রদায়িক। এদের পরিচয় পর্বে হিন্দু মুসলমান শব্দ দুটি অনুচ্চারিত থেকে যেতো, যা কিছু ব্যবধান তা আচারে আচ্ছাদনে। তার কুন্ঠিতচিত্তে নিবেদন করতো ক্ষুদ্র হৃদয়ের মহৎ অর্ঘ্য।
নারকেল-মুড়ি খৈ, বাতাসা, কলায় এবং পায়েসেরও কখনো জমে উঠতো স্তুপ। যার সেবায় অবাধ অধিকার ছিলো সার্বজনীন। জাত ধর্মহীন গঞ্জিকাসেবী সন্যাসীদেরও ভিড় জমতো কখনো কখনো। এদের সবাই গৈরিক বসনধারী ছিলো না, রক্তলাল বসনে ভয়ংকর রূপে বসে থাকতো কেউ। কারো কন্ঠে রুদ্রাক্ষের মালা, কারো চিমটা হাতে কেউ ত্রিশুলধারী। কেউ বিচিত্র বর্নের বড় পুঁতির বা পাথরের অথবা লোহার শেকল পড়তো গলায়। এদের কারো বিশেষ তরিকা ছিলো না, তা বহুবর্নের বেশবাস দেখেই বোঝা যেতো। এরা কেনো দরগা খোলায় জড়ো হতো বা থাকতো দিনের পর দিন, কে জানে! শাহমাদারের প্রতি এদের বিশ্বাস ভক্তি প্রশ্নাতীত নয়। এদের কেউ মাদার শাহের অনুসারী মাদারী ফকির, যে ধর্মোদ্রোহী লম্পট হয়েও সন্যাসীর বেশভূষায় থাকতো তার শিষ্য হওয়াও বিচিত্র নয়।...এদের প্রতি কারো শ্রদ্ধা থাকতে পারে কিন্তু প্রায় সকলেই যে এদের ভয় পেতো, তা ছিলো সন্দেহাতীত।... তাঁর নামে বার্ষিক উৎসব হয় বাঁশ উত্তোলন করে। এখনো এখানে বাঁশের শীর্ষে বিচিত্র বর্নের ফড়ল্লা উড়িয়ে ঢাকি নামায় মিছিল করে। ওরসের জন্য অর্থ এবং চাল মাগে, মারফতি গান গায় রাতের পর রাত। শিন্নি বিতরণ করা হয় দারিদ্রনারায়ণে।১১ হালের প্রত্যক্ষদর্শীদের বলা নিষ্প্রয়োজন, শাহমাদারের দরগা খোলায় বর্নিত চিত্র এখন অনুপস্থিত।
প্রকৃত ঐতিহাসিক তথ্য মতে, সৈয়দ বদিউদ্দিন জিন্দা শাহমাদার (১৩১৫-১৪৩৪ খ্রিঃ) ২৪২ হিজরিতে সোমবার ঈদুল ফিতরের সুবহে সাদিকে ফাতেমা সোনিয়ার গর্ভে সিরিয়ার হালাম তৎকালীন শাম শহরে (বর্তমানে এ শহরের পরিবর্তিত নাম Aleppo) জন্মগ্রহণ করেন। কুতুব-উল-মাদার তাঁর উপাধি ছিলো। কথিত আছে, খাজা খিজির তাঁকে আতুড় ঘরে দেখতে আসেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ কাজী ফিদ্বাতুদ্দিন হালারি।
গুলজার-ই-মাজার গ্রন্থের লেখক মাওলানা সৈয়দ মেহমুদ বর্ননা করেন যে, সৈয়দ বদিউদ্দিন জিন্দা শাহমাদার বিশিষ্ট সাহাবী হযরত হুযাইফা (রাঃ) এর উত্তর পুরুষ ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ করেন। তিনি চারখানি আসমানী কিতাবেই সমান ব্যুৎপন্ন ছিলেন। সৈয়দ বদিউদ্দিদিন জিন্দা শাহমাদারের পীর ছিলেন বায়েজিদ তায়ফুর আল বোস্তামি। তাঁর তরিকার নাম ‘তায়ফুরিয়া’ আর শাহমাদারের তরিকার নাম ‘মাদারিয়া’।
পঞ্চদশ থেকে সপ্তদশ শতকের মধ্যে উত্তর প্রদেশ, মেওয়াট অঞ্চল, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, নেপাল এবং বাংলাদেশে সূফি তরিকার বিস্তৃতি ঘটে। তবে পূর্ববঙ্গে এ সূফি তরিকার মধ্যে হিন্দু যোগীদের ভাবধারা ঢুকে পড়ে। ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুর দেহাট জেলার মাকানপুর শহরে তাঁর সমাধিক্ষেত্র রয়েছে। প্রবল প্রতাপান্বিত মোগল সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গীর ও আওরঙ্গজেব তাঁর মাজার শরীফ জেয়ারত করেন। জীবদ্দশায় তিনি সিরিয়া, ইরান, পাকিস্তান, বাংংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, বাগদাদ, তুরস্ক, ইরাক ও সৌদি আরব সফর করেন। সারা ভারত সফরকালে যে সব স্থানে তিনি ক্ষণিক অবস্থান করেছিলেন, তাঁর চলে যাবার পর ভক্তগন সে সব স্থানে ‘চিল্লা’ গড়ে তোলে।
ভারতের ১৩ টি স্থানে শাহমাদারের চিল্লা রয়েছে। অনেক স্থানে ভক্তরা নকল মাজার তৈরি করে ভক্তি শদ্ধা নিবেদন করতে শুরু করে। বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলা ও সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুরে এমন নকল মাজার বা দরগা শরীফের দু'টি দৃষ্টান্ত। যেখানেই মাদারী সম্প্রদায়ের ফকিরেরা আস্তানা গেড়েছে বিপুল সংখ্যায়, শাহমাদারের নামের সাথে যুক্ত করে সে সব স্থানের নতুন নামকরণ করেছে তারা। এ ছিলো তাদের ভক্তি প্রকাশের একটি ধরন। এ কারণে ভারতের উত্তর প্রদেশে এবং বাংলার রাঢ় ও বরেন্দ্র অঞ্চলে মাদারহীল, মাদারপুর, পুরামাদার, মাদারীপুরা, মাদারীপুর, মাদারগঞ্জ, মাদারতলা, মাদারদী প্রভৃতি স্থানের নাম পাওয়া যায়। ১২
ড. সুপ্রকাশ রায়ের ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের ফকির ও সন্ন্যাসীদের জনসাধারণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে তারা কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তোলে। এই বিদ্রোহ ইতিহাসে ফকির বা সন্ন্যাস বিদ্রোহ নামে পরিচিত। ১৭৬০ থেকে ১৮১২ সাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ফকির বিদ্রোহে সারা ভারতের নেতা ছিলেন মজনু শাহ্ আর বাংলাদেশের নেতা ছিলেন মঞ্জু শাহ্। তিনি শাহ্ সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহান কর্তৃক মাদারিয়া বা মাদারী তরিকার খিলাফত প্রাপ্ত হন। ১৭৬৩ সালে ফকিরগণ বরিশালে ইংরেজ কোম্পানির কুঠির উপর হামলা চালায় বলে ওয়ারেন হেস্টিংস এর একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়।১৩ সুতরাং এ থেকে ধারণা করা যায় যে, মাদারীপুর এলাকাতেও তখন মাদারিয়া তরিকার ফকিরদের যথেষ্ট প্রভাব ছিলো।১৪
তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৩৪,৩৫,৩৬,৩৭)
এই ছিলো মাদারীপুর জেলার নামকরণ এবং নামকরণের ইতিহাস।
ধন্যবাদ...
0 Comments
•Do Not Share Any Link.
Thank You•