Ticker

7/recent/ticker-posts

মাদারীপুরে নীল বিদ্রোহ | ইতিহাসের পাতায়

১৭৭৭ সালে ফরাসী বণিক লুই (বন্নো) মতান্তরে লুই রোলড সর্বপ্রথম বাংলাদেশে এসে চন্দন নগরের নিকটবর্তী তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় দুটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। ১৮১৪ সালে তিনি বাঁকীপুরের নীল ব্যবসায় যোগ দেন এবং যশোরের নহাটা কারবারের মালিক হন। ১৮২১ সালে মৃত্যুর পূর্বে তিনি কালনা থেকে এক বছরে চৌদ্দশো মন নীল ইউরোপের বাজারে বিশেষত, ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের জন্য রপ্তানি করে প্রচুর অর্থ আয় করেন। তখন এক মন নীলের দাম ছিল ২৩০ টাকা। ১৭৯৫-১৮৩০ সালের মধ্যে খুলনা-যশোর-ফরিদপুর অঞ্চলে নীলকুঠিতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। খুলনার লোনা অঞ্চলে নীলচাষ বিস্তৃত হতে পারেনি। নীল প্রস্তুতকরণে প্রচুর পরিষ্কার মিঠাপানির প্রয়োজন হত। পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ ও কুমার নদীর মিঠাপানি বিধৌত মাদারীপুর অঞ্চলে ১৮২৬ সালের দিকে নীলচাষের ব্যপক বিস্তৃতি ঘটে।

Madaripur nil chash

১৮১৯ সালের অষ্টম রেগুলেশনে পত্তনী তালুক বন্দোবস্ত দেয়ার অধিকার প্রদান করায় একেক পরগনার মধ্য অসংখ্য তালুকের সৃষ্টি হয়। ইংরেজ নীলকর সাহেবদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এ দেশীয় ধনবানেরাও নিজ জমিদারির মধ্যে অথবা অন্য জমিদারির মধ্যে তালুক পত্তনী নিয়ে নীল কারবার শুরু করে। অনেকে নানাবিধ সুবিধা হাসিলের জন্য সাদা চামড়ার ইংরেজ ম্যানেজার নিয়োগ করে। দেশীয় নীলের কারবার একক মালিকানা অথবা যৌথ মালিকানায় কোম্পানি গঠন করেও চলত। এসব কোম্পানিগুলো কানসারন্ নামে সমধিক পরিচিত ছিল। 

প্রথমদিকে নীলচাষ থেকে কৃষকরা লাভবান হলেও পরে নীলচাষ চাষীদের কাছে লাভজনক না থাকায় তারা ধান ও পাঠ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠে। কিন্তু নীলকর মালিকেরা জোরপূর্বক চাষীদের নীলচাষে বাধ্য করে। নীলচাষ করতে না চাইলে কৃষকদের উপর অত্যাচার নির্যাতন শুরু করে। নীলকুঠিয়ালগন কার্যত কৃষকদের মধ্যযুগীয় ভূমিদাসে পরিণত করে। অত্যাচার নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে কৃশকরাও শেষে নীলচাষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরে। সহিংস ও সংগঠিত নীল প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু করে। কাঠগড়া ও কনসারনে প্রথম নীল বিদ্রোহ শুরু হয়। এরপর দ্রুত নদীয়া, যশোর, ফরিদপুর-মাদারীপুরের সর্বত্র নীল বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে।

এ সময়ে ফরিদপুর মাদারীপুর অঞ্চলে নীল কুঠিয়ালদের অত্যাচার যে কত ভয়ংকর রূপ নিয়েছিল তা দেতালুর সাহেবের বর্ননা থেকে জানা যায়। দেতালুর সাহেব ১৮৪৮ সালে ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। নীল কমিশনের নিকট প্রদত্ত সাক্ষ্যে তিনি বলেন — ‘এরূপ এক বাক্স নীলও ইংল্যান্ডে পৌঁছায় না, যা মানুষের রক্তে রঞ্জিত নয়- এমন উক্তির জন্য মিশনারিদের সমালোচনা করা হয়েছে। কিন্তু এটা আমারও কথা। ফরিদপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে আমি যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তার ভিত্তিতে আমি জোরের সাথে বলতে চাই যে, এ মন্তব্য সম্পূর্ণ সত্য। কতিপয় প্রজার লাশ আমার সামনে আনা হয়েছিল, যাদেরকে নীলকর ফোর্ড গুলি করে হত্যা করেছিল।’

১৮৮০ সালের মধ্যে ফরিদপুর-মাদারীপুরে নীলচাষের অবসান ঘটে। আক্ষেপ করে ইংরেজ ও’ম্যালী বলেন এ জেলার ইতিহাসের বিবরণ সম্পূর্ণ হবে না, যদি না জেলার নীলশিল্প কী করে ধ্বংস হলো তা আলোচনা করা না হয়।


এক সময় গড়াই, মধুমতি, বারাসিয়া, চন্দনা, কুমার প্রভৃতি নদীর তীরবর্তী জমিতে নীলচাষ করা হত। আলফাডাঙ্গা ও মীরগঞ্জে প্রধান দুটি কুঠিস্থাপন করা হয়েছিল। বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় মোট ৫২ টি নীলকুঠি ছিল। তন্মধ্যে ২২ টি নীলকুঠি ছিল মাদারীপুর অঞ্চলে। 

শিবচর থানার পাঁচচরে এবং মাদারীপুর সদর থানার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামে, রাজৈর ও কাশিপুরে স্থাপিত নীলকুঠির ইংরেজ কুঠিয়াল ছিলেন এন্ড্রু এন্ডারসন ডানলপ। নীলচাষের বিরোধিতা করায় ফারায়েযি আন্দোলনের নেতা পীর দুদুমিয়ার সাথে তার বিবাদ শুরু হয়। ডানলপ দুবার দুদুমিয়াকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করায়। তাঁর বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা ডাকাতির মামলা দায়ের করলেও  সাক্ষীর অভাবে তিনি অব্যাহতি পান। 
ডানলপের গোমস্তা মাড়োয়ারি কালীপ্রসাদ কাঞ্জিলাল কৃষকদের জোর করে নীলচাষে বাধ্য করতেন। ১৮৪৫ সালের অক্টোবর মাসে হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের সহযোগিতায় ৭/৮ শত লোক নিয়ে কাঞ্জিলাল বাহাদুরপুরের দুদুমিয়ার বাড়ি আক্রমণ করে। তারা ঘরের সদর দরজা ভেঙ্গে ফেলে। চারজন পাহারাদারকে হত্যা করে এবং অন্যদের জখম করে। নগদ অর্থ ও দ্রব্যসামগ্রী মিলিয়ে দেড়লাখ টাকা মূল্যের সম্পদ লুট করে নেয়। থানায় এ ব্যাপারে মামলা করতে গেলে পুলিশ কর্মকর্তা মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ উল্টো অস্ত্র রাখার অভিযোগে আহত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে কোর্টে চালান দেয়। অগত্যা দুদু মিয়া নিরুপায় হয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নেন। ১৮৪৫ সালের ডিসেম্বর তিনি ৪০০ কৃষক নিয়ে পাঁচচরে নীলকুঠি আক্রমণ করে ধূলিসাৎ করে দেন। ফারায়েযি বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন কাদের বক্স। ডানলপ অনুপস্থিত থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। কৃষকেরা নীলকুঠির গোমস্তা কাঞ্জিলালকে বন্দী করে বাকেরগঞ্জের দক্ষিণে নিয়ে যায় এবং গলাচিপা থানার মৌডুবি চরে তাকে হত্যা করে লাশ বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেয়। 
দুদু মিয়াসহ ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। দায়রা আদালত তাদের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড প্রদান করলেও কলকাতার সদর নেজামত আদালতে আপীল করলে সবাই বেকসুর খালাস পান। এ ঘটনায় মাদারীপুরের নীলকরের অত্যাচার হ্রাস পায়। তবে ১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহের এক উত্তাল দিনে মুকসুদপুর থানার চাঁদেরহাট নারায়ণদিয়ার ধনুমিয়া ও তাঁর অনুসারীদের হাতে অত্যাচারী নীলকর ডানলপ নৃশংসভাবে নিহত হয়।
মাদারীপুর সদর উপজেলাধীন আওলিয়াপুর গ্রামেও ডানলপের একটি নীলকুঠি ছিল। পীর দুদুমিয়া আওলিয়াপুরের নীলকুঠিও আক্রমণ করেন। যে স্থানে উভয়পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয় তা রণখোলা নামে খ্যাত। আওলিয়াপুর নীলকুঠি মাদারীপুর জেলার একটি প্রাচীনতম নিদর্শন। উনিশ শতকের মধ্যভাগে রাজৈরে নীলচাষ হত এবং এখানে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ এখনও বর্তমান আছে। ১৮৬২ সালে জবরদস্তিমূলক নীলচাষের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার আইন পাস করে।

তথ্যসূত্র“মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৫১, ৫২, ৫৩)


Post a Comment

0 Comments