১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর লর্ড কার্জন (১৮৯৮-১৯০৫) ভাইসরয় থাকাকালীন সময়ে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয়। বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ১৯০৩ সালে প্রথম বিবেচনা করা হয় এবং ১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয়। পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্য, চট্টগ্রাম, ঢাকা ও দার্জিলিং বাদে রাজশাহী বিভাগসমূহ এবং মালদা জেলাকে আসামের সাথে যুক্ত করে ‘পূর্ব বাংলা ও আসাম’ নামে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয় এ নতুন প্রদেশের রাজধানী হবে ঢাকা এবং অনুসঙ্গী সদর দপ্তর হবে চট্টগ্রামে।
শিক্ষিত বাঙালি, মধ্যবিত্ত হিন্দু ভদ্রলোকেরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে। তাদের অভিমত ছিল, নতুন প্রদেশ সম্পূর্ণ বিহার ও উড়িষ্যা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশেই বাঙালিরা সংখ্যালঘুতে পরিনত হবে। তারা অভিযোগ তোলে যে, এটা ছিল বাংলার জাতীয়তাবাদী চেতনাকে শ্বাসরুদ্ধ করতে কার্জনের কৌশলী প্রচেষ্টা। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করত যে, শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ের অতিদ্রুত বর্ধনশীল শক্তিমত্তাকে ব্যহত করার উদ্দেশ্যে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ব বাংলার মুসলিম প্রভাব বাড়ানোকে উৎসাহিত করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য ছিল। কারণ প্রস্তাবিত নতুন প্রদেশে মুসলিমগণ হিন্দুদের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। তাই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে তীব্রতর করতে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক স্বার্থরক্ষার খাতিরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালির একত্রে জোট বেধে স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা করে। স্বদেশী আন্দোলন ১৯০৫ সালে শুরু হয়ে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত চলমান ছিল। এ আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রধান ও স্বারকলিপি পেশের মধ্যে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ব্রিটিশ পন্যবর্জন, রাখিবন্ধন, অরন্ধন ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সুরেন্দনাথ ব্যানার্জী ছিলেন স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ডি.এল. রায়, রজনীকান্ত সেন ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশাত্মবোধক সঙ্গীত কবিতা রচনার মাধ্যমে এ আন্দোলনকে জনপ্রিয় ও বেগবান করে তোলেন।
সম্পর্কিত আর্টিকেল :
১৯০৪ সালের জানুয়ারি মাসে বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করা হলে এ বছরের ১৭ জানুয়ারিতে ফরিদপুর শহরে মাদারীপুর মহকুমাধীন রাজৈর থানার সেনদিয়া গ্রামের অম্বিকাচরণ মজুমদারের নেতৃত্বে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৭ সালে স্বদেশী আন্দোলন পরিচালনার জন্য অম্বিকাচরণ মজুমদারকে সভাপতি করে ফরিদপুরে একটি কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটির নেতৃত্বে ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে এক হাজারের বেশি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ীর সকল উকিল, মোক্তার স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেয়। মাদারীপুর মহকুমায় স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন পালং থানার যদুনাথ পাল। তিনি মাদারীপুরের বানিজ্য বন্দরগুলোতে সভা করে মহকুমাবাসীকে বিদেশি পন্য বর্জন ও দেশীপন্য ব্যবহারের আহ্বান জানান। তাঁ আহ্বানে সাড়া দিয়ে গ্রামেগঞ্জে চরকা কাটা শুরু হয়। ১৯০৬ সালের ২৮ জানুয়ারি মাদারীপুরের হবিগঞ্জের জমিদার গোলাম মাওলা চৌধুরীর বাসভবনে শশধর তর্কচূড়ামণির সভাপতিত্বে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় আনুমানিক সাত হাজার লোক যোগদান করে। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজারের মতো মুসলমান ছিল। ‘১৯০৫ সনে স্বদেশী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়। সেই আন্দোলনে থর থর করে কেঁপে উঠেছিল মাদারীপুর শহর আর শহরতলী। তার বেগ আর আবেগ ছড়িয়ে পড়েছিল গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। দুলে আর ফুলে উঠেছিল সাধারণ থেকে অসাধারণ মানুষের বুক, ভাষা আর আশা। ঐ আন্দোলনের আগ্নেয়গিরি ছিলেন পুন্যশ্লোক কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্ত। তিনি ছিলেন মাদারীপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। তাঁরই নিরলস সযত্ন চেষ্টায় গড়ে উঠল স্বদেশী মানসিকতা। লাঠিখেলা, তলোয়ার চালান, বর্শাছোঁড়া থেকে থিয়েটার করা পর্যন্ত তিনি স্বদেশী মন তৈরি করার অনেক অনুষ্ঠান প্রবর্তন করেন।’১০
স্বদেশী আন্দোলনের পরিনামে ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে সম্রাট পঞ্চম জর্জ দিল্লী অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রোধ ঘোষণা দেন। ১৯১২ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ কার্যকর হয়। স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম সাধন সাফল্য হলো, বাঙালি জাতীয়তাবোধের উজ্জীবন এবং বাংলা সাহিত্যে তার বর্নিল প্রতিফলন।
তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৫৩, ৫৪, ৫৫)
0 Comments
•Do Not Share Any Link.
Thank You•