Ticker

7/recent/ticker-posts

সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে মাদারীপুর

ইতিহাসের পাতায় মাদারীপুর

স্বদেশী আন্দোলন মুখ্যত শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে বিকাশ লাভ করে। এ আন্দোলনের নের্তৃত্বেও ছিলেন তারা। কলকাতা ভিন্ন মফঃস্বল শহরগুলোতে যেখানে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের ছিল গুচ্ছ বসবাস, সেখানেই এ আন্দোলন অধিকতর বিস্তার লাভ করে। স্বদেশী আন্দোলনের অভীষ্ট লক্ষ্য বঙ্গভঙ্গ রদ অর্জিত হলেও এ আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি বঙ্গভঙ্গ রদের আপাত সাফল্যের গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকেনি। এ কথা অস্বীকার করা চলেনা যে, স্বদেশী আন্দোলন ছিল বাংলায় সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের সূতিকাগার। যেখানেই স্বদেশী আন্দোলন তীব্রতা পেয়েছে সেখানেই পরবর্তীতে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে উঠেছে। একই কারণে মাদারীপুরেও সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন পুষ্ট ও বেগবান হয়েছে। 

লর্ড মিন্টো (১৯০৫-১৯১০ খ্রিঃ) বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন রোধ করার উদ্দেশ্যে দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করলে প্রকাশ্য পথ পরিত্যাগ করর আন্দোলন গুপ্তপথে পরিচালিত হয়। ব্রিটিশ ভারতে এভাবে সন্ত্রাস ও বিপ্লববাদের উত্থান ঘটে। ইংরেজদের সাথে জাতীয় কংগ্রেস দলের আপোষকামী আবেদন নিবেদনের নতজানু রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এবং এ পথে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন সুদূর পরাহত বিবেচনা করে স্বদেশী আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ গ্রহনকারী আত্মত্যাগী ছাত্র-যুব সমাজের অনেকে সন্ত্রাসবাদে আগ্রহী হয়ে ওঠে। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

১৯০৬ সালে কলকাতার ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্রের উদ্যোগে বাংলায় প্রথম সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়।১১

এ সমিতির সভাপতি হন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র এবং সহসভাপতি ও কোষাধ্যক্ষ হন যথাক্রমে চিত্তরঞ্জন দাসগুপ্ত ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।  অনুশীলন সমিতির মূল লক্ষ্য ছিল সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করা। এই সমিতির সঙ্গে ক্রমে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন), অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ প্রমুখ বিখ্যাত বিপ্লবী যুক্ত হন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক বিদ্রোহাত্মক কবিতা গান অনুশীলন সমিতির সদস্যদের উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রতি তিনি অন্তরে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পোষণ করতেন।১২

১৯০৬ সালে অন্তর্দলীয় (আন্তঃব্যুহ) বিতর্কের পরিণামে এবং দেশবাসীকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ করার মানসে অনুশীলন সমিতির একদল বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে।১৩

এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের অন্যতম গুপ্ত সংগঠন যুগান্তর দল গড়ে ওঠে।১৪ 

অতঃপর পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব ক্রমে অনুশীলন সমিতি ও ‘যুগান্তর দলের শাখা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পূর্ব বাংলায় অনুশীলন সমিতির শাখা বিস্তারের দায়িত্ব মাদারীপুর মহকুমার পালং থানার লোনসিং গ্রামের ডেপুটি বাড়ির পুলিনবিহারী দাসের উপর ন্যস্ত করা হয়। পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার এই কেন্দ্রের কর্মতৎপরতায় সমগ্র ভারতে এবং বার্মায় অনুশীলন সমিতি বিস্তার লাভ করে।১৫

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

‘অনুশীলন সমিতি’র ফরিদপুর শাখায় তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমার বিলাসখান গ্রামের আশুতোষ কাহেলী, জীবন ঠাকুরতা, নলিনী ভট্টাচার্য, চিত্ত কাহেলী, ধীরেন আতর্থী, সুবোধ রায়; কোঁয়াপুরের কেদারেশ্বর সেনগুপ্ত, ফতেজংপুরের ধীরেন চট্টোপাধ্যায়, শলেদহের দীনেশ বিশ্বাস, আশু চক্রবর্তী, ভুবন বসে, পালংয়ের শচীন কর, প্রমথ গুহ, প্রথম সরকার প্রমুখ প্রধান ছিলেন। পুলিনবিহারী দাসকে ১৯০৮ সালের ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। ১৯১০ সালে ভারতে ব্রিটিশরাজ উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের ষড়যন্ত্র মামলায় পুলিনবিহারী দাসকে দীর্ঘ মেয়াদী কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। 

অনুশীলন সমিতির সভাপতি প্রমথনাথ মিত্র এবং পুলিন দাস গঠনমূলক কাজের প্রতি বেশি জোর দেয়ায় বারীন্দ্র ঘোষের সঙ্গে তাদের মতবিরোধ ঘটে। বারীন্দ্র ঘোষ তাঁর অনুসারী চরমপন্থীদের একত্র করে পত্রিকার নামানুসারে যুগান্তর দল গঠন করে। এই যুগান্তর দলই অনুশীলন সমিতি অপেক্ষা বোমা তৈরি এবং কার্যকর সামরিক এ্যাকশনের প্রতি অধিকতর মননিবেশ করে। পরবর্তীকালে যুগান্তর দল থেকেই উগ্র বিপ্লবপন্থি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার দল গঠিত হয়। ফরিদপুরে যুগান্তর দলের পৃষ্ঠপোষক ও প্রধান ছিলেন মাদারীপুর মহকুমার ইশিবপুরের খ্যাতনামা বিপ্লবী পূর্নচন্দ্র দাস১৯১০ সালে তিনি মাদারীপুর শহরে দেশপ্রেমিক সাহসী সন্তানদের নিয়ে মাদারীপুর সমিতি গঠন করেন।১৬

এ সমিতি রাজনৈতিক ডাকাতিকে বিপ্লবের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। তাঁর দলে ২৭ জন বিপ্লবী ছিল। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিনোদ দাশ, বামন চক্রবর্তী,  চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, রাধাচরণ প্রামাণিক, খালিয়ার কালীপ্রসাস ব্যানার্জী, মাদারীপুর শহরের পঞ্চানন চক্রবর্তী, বিজয়নন্দ দত্ত, প্রফুল্ল চট্টোপাধ্যায়, ফণী মজুমদার, অমলেন্দু দাশগুপ্ত, নলিনী গুহ, ডা. হরিপদ চক্রবর্তী, জিতেন কুশারী, নগেন চক্রবর্তী ; কেন্দুয়ার সন্তোষ দত্ত, প্রতাপ গুহ রায়; স্বরমঙ্গলের হরিদাস ও সুফী জোনাব আলী প্রমুখ বিপ্লবী। ১৯১২ সালে পূর্নচন্দ্র দাসের নেতৃত্বে টি গেরিলা যুদ্ধ-ডাকাতি অনুষ্ঠিত হয়।

পূর্নচন্দ্র দাস প্রতিষ্ঠিত মাদারীপুরের শান্তিসেনা নামক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৎকালীন সরকারি কর্মচারীদের মনে প্রচন্ড ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। মাদারীপুর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট ডনোভান শান্তিসেনার কার্যকলাপের দায়ে পূর্নচন্দ্র দাসকে গ্রেফতারের জন্য পুরষ্কার ঘোষণা করেন। পূর্নচন্দ্র দাসকে ধরার জন্য শুরু হয় ব্যপক ধরপাকর ও পুলিশী নির্যাতন। পূর্নচন্দ্র দাস স্বীয় দলের সদস্যদের নিরাপত্তার বৃহত্তম একদিন সরাসরি ডনোভানের এজলাসে হাজির হয়ে নিজেকে ফেরারি পূর্নচন্দ্র দাস পরিচয় দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এত বড় মাপের একজন সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীর আকস্মিক উপস্থিতিতে বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমুঢ় ডনোভান চেতন হারিয়ে চেয়ারে ঢেলে পড়েন। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

মাদারীপুর শহর ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় পূর্নচন্দ্র দাসের বিপ্লবী সংগঠনের বিস্তৃতি ঘটলে সংগঠন চালাবার জন্য অর্ধেক টান পড়ে। ভিক্ষার অর্থ দিয়ে সংগঠন চলে না এবং তাতে গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যাবার খুবই সম্ভাবনা থাকে। ১৯১০ সালে এক চীনা চালানদারের সাথে পূর্নচন্দ্র দাসের গোপন চুক্তি হয়। বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সে বার্মা যাবার পথে জাহাজ  থেকে অস্ত্র নামিয়ে দেবে বিপ্লবীদের হাতে। এত টাকা অভিভাবকের দেয়া ছাত্র-বেতন আত্মসাৎ করে কিংবা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। অভিজ্ঞতা থেকে বিপ্লবীরা বুঝেছিলেন ভিক্ষায়াং নৈব নৈবচ। তাই পূর্নচন্দ্র দাস সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্যে বিত্তবানদের কাছ থেকে জোর করে টাকা কেড়ে নিতে হবে। পুলিশের সন্দেহের উদ্রেক না করে নিজের কর্মীদের নিরাপদ রাখার স্বার্থে তিনি পদ্মানদীর অপরপারে ঢাকা মানিকগঞ্জে ডাকাতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে মানিকগঞ্জের রজনী মোক্তারের দাতব্য ছাত্রাবাসের বিপ্লবী উপদলের সহযোগিতায় মানিকগঞ্জের এক ধনাঢ্য বাবুর বাড়িতে যাত্রাপালা চলাকালে পিস্তল উঁচিয়ে সফলভাবে প্রথম ডাকাতি সম্পন্ন করে। এরপর একই বছরের ২৩ জানুয়ারি বাইগুনতেওয়ারিতে সংঘটিত ডাকাতি থেকে সংগৃহীত হয় ৩,৪৭০ টাকা, ২১ ফেব্রুয়ারি আইনাপুর, ১৮ নভেম্বর ঢাকার কোলায় এবং ১৯১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভরাকৈরে মাদারীপুর দল ডাকাতি করে। পূর্নচন্দ্র দাসের নিখুঁত পরিকল্পনায় পুলিশ এ সব ডাকাতির সাথে মাদারীপুরের বিপ্লবীদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ঘূনাক্ষরেও সন্দেহ করতে পারেনি। সিডিশন কমিটির রিপোর্টে এ সব ডাকাতি সম্পর্কে মন্তব্য করে বলা হয় যে, এই দলের ধরনটাই ভীতি উৎপাদক। মুখোসপরা মানুষ আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এবং জলন্ত মশাল নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে নির্দিষ্ট গৃহে আক্রমণ করার সময় ভীষণ চিৎকার করে, বোমা ফাটায় এবং গুলি ছুড়ে আর কর্তব্য শেষে তূর্যধ্বনির সংকেতে শ্রেনিবদ্ধ হয়ে একত্রে অপসৃত হয়। এভাবে কয়েকটি ডাকাতির মাধ্যমে ডাকাতির কৌশল আয়ত্ব এবং অভিজ্ঞতার ঝুলি স্ফীত হলে অতঃপর পূর্নচন্দ্র দাস নিকটবর্তী এলাকার দিকে দৃষ্টি দেন। ১৯১৩ সালের এপ্রিল কালকিনির গোপালপুরে স্বদেশী ডাকাতি হয়। এখানে কয়েক হাজার হিন্দু মুসলমান গ্রামবাসী চক্রাকারে ব্যুহ রচনা করে বিপ্লবীদের ঘিরে ফেলেন। বহু কষ্টে এ ব্যুহ ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে তারা সক্ষম হয়। আসল হদিস না পেয়ে গোপালপুরের ডাকাতিতে পুলিশ বরিশাল শঙ্করমঠ দলের উপর ক্ষিপ্ত হয়। 

বিপত্তি ঘটে ১৯১৩ সালের ১৯ এপ্রিল সদর থানার কাউয়াখুড়ির ডাকাতির ঘটনায়। সফলভাবে ডাকাতির কাজ শেষ হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বিপ্লবীদের ফিরতে বিলম্ব হয়। মাদারীপুর শহর থেকে এ গ্রামে পৌঁছানোর কোনো সরকারি বা বেসরকারি রাস্তা ছিল না। জমির আইলের উপর দিয়ে চলাফেরা করতে হত। গ্রামের চতুর্দিকে অবারিত মাঠ। সে মাঠের বুক ভরে ছিল হাটু সমান পাঠ, কোথাওবা ধান। কয়েক দিনের ঝড়জলের অবিশ্রান্ত বর্ষণে সে মাঠও গিয়েছিল তলিয়ে। তাই ঘরে ফিরতে বিলম্ব ঘটে। বিপ্লবী কাজের তাগিদেই মাদারীপুরে ফিরে আসার তাড়া ছিল। প্রত্যুষে এ সব ছেলেদের শহরে ফিরতে দেখে লোকদের মধ্যে কারো কারো সন্দেহ হয়। এ সন্দেহের খবর পুলিশের কানে পৌঁছে গেলে পুলিশ মাদারীপুরের ৮৭ জন সন্দেহভাজন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। মাস দুয়েকের মধ্যে ৬০ জন জামিনে মুক্তি পায়। বাকি ২৭ জনকে আসামি করে শুরু হয় ‘ফরিদপুর ষড়যন্ত্র মামলা’।


এই মোকদ্দমায় আসামি দল এক অদ্ভুত আচরণ করে দু'পক্ষের উকিল মোক্তার এমনকি বিচারককেও বিমুঢ় করে দিলেন। তাঁরা সাক্ষী মানলেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। এই মোকদ্দমা পরিচালনার দায়িত্ব, ধরপাকর, ব্যক্তিগত ও দলগত সংবাদ সংগ্রহ সবই ছিল আই.বি ইন্সপেক্টর অশ্বিনী বাবুর এক্তিয়ারে। তাঁর গোপন ডায়েরি গেল খোয়া। সেটা বিপ্লবীদের হাতে চলে যায়। ঐ ডায়েরিতে এমন সব গোপন তথ্য ছিল যা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অস্বীকার করার উপায় ছিলনা। আবার স্বীকার করলে কেবল মোকদ্দমাই ফেঁসে যায় না, সাহেব নিজেই নিজের জালে যান জড়িয়ে। অতএব জরুরি ছুটি নিয়ে সাহেব বিলাতে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেন; কিন্তু আদালতের পরওয়ানা ধাওয়া করে তাকে ধরে ফেলে বোম্বাইয়ে এবং ফিরিয়ে আনে ফরিদপুরে। অবশেষে সাহেবের মুখ আর সরকারের মানরক্ষার গরজে মোকদ্দমাটি গুটিয়ে নিতে হয়। সরকারি ষড়যন্ত্রের এ রকম বেকায়দা আর বোকামির সম্ভবত এটা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

১৯১৪ সালের ২৬ আগস্ট রডা কোম্পানির ২০ বাক্স রাউজার পিস্তল ও টোটার একটি চালান কাস্টমার হাউস থেকে কৌশলে ভোজবাজির মতো পাচার হয়ে যায় বিপ্লবীদের কাছে। এ অস্ত্রের বড় একটা অংশ তুলে দেয়া হয় মাদারীপুর দলের হাতে।

১৯১৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নীরেন্দ্র, মনোরঞ্জন ও চিত্তপ্রিয়ের নের্তৃত্বে গার্ডেন রিচে ডাকাতি হয়। এ ডাকাতিতে প্রথম মোটরগাড়ি ব্যবহার করা হয়। বিপ্লবীদের হাতে আসে ১৮ হাজার টাকা। ২২ ফেব্রুয়ারি বেলেঘাটার ললিতমোহন ও বৃন্দাবন সাহার গদি থেকে ডাকাতি করে সংগ্রহ হয় বাইশ হাজার টাকা। ২৪ ফেব্রুয়ারি পুলিশের আই.বি ইন্সপেক্টর সুরেশ মুখার্জীকে দিনে দুপুরে কোলকাতার কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটেট প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী। অতি উৎসাহী এ পুলিশ অফিসার বিপ্লবীদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তাই বাঘা যতীন পণ করলেন সুরেশ মুখার্জীর মৃত্যু সংবাদ না শোনা পর্যন্ত তিনি কিছু খাবেন না। বাঘা যতীনের অনশন ভাঙ্গাতে পিস্তল হাতে নেমে পড়ে চিত্তপ্রিয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনে দুপুরে হেদোর দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটের বিস্তৃত চত্বরে সুরেশ মুখার্জীর গুলিদীর্ণ বক্ষদেশ হাতে গড়িয়ে পড়া তাজারক্ত হাতে মেখে নিয়ে হাজির হন নেতার সামনে। ভাঙ্গেন তাঁর অনশন। জয়দ্রথবধের মতোই পালিত হলো প্রতিজ্ঞা। এ দুঃসাহসিক হত্যাকাণ্ডে সমগ্র কলকাতায় আতঙ্ক আর চাঞ্চল্যের ঝড় বয়ে যায়। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 


বাংলার অবিসাংবাদিত মহানায়ক যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের (বাঘা যতীন) নেতৃত্বে অতঃপর বিপ্লবী দল যুগান্তরঅনুশীলন একত্র হয়। বাংলায় গেরিলা পদ্ধতিতে যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা প্রথম যুদ্ধ করেন ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বর উড়িষ্যার বালেশ্বরের কাছে সমুদ্রের বালুচরে। এ যুদ্ধ বালেশ্বরের যুদ্ধ নামে খ্যাত। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯ খ্রি:) চলছে। ইংরেজরা অক্ষশক্তি জার্মানীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। বিপ্লবীরা ভেবেছিলেন, এই সময় জার্মানীর কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ করা গেলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে দু'টি সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতা করেছে তার প্রথমটি ছিল জার্মান এবং দ্বিতীয়টি প্রতিবেশী আফগানিস্তান। মুন্সিগঞ্জের নরেন্দ্র ভট্টাচার্য যিনি এম এন রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়) ছদ্মনামেই সমধিক পরিচিত, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা যুদ্ধের অস্ত্র সংগ্রহে ব্যাপৃত ছিলেন। তিনি সেন্টমার্টিন ছদ্মনামে জার্মানি যান অস্ত্র সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে। জার্মানির সম্রাট কাইজারের সাথে বিপ্লবীদের গোপন চুক্তি হয়। চুক্তির শর্তানুযায়ী তিন জাহাজ বোঝাই অস্ত্র আসার নির্ধারিত দিনক্ষণ সমাগত। প্রেরিত জাহাজ বোঝাই অস্ত্র সুন্দরবনের রায়মঙ্গলে নামানোর কথা হয়। কিন্তু এত অস্ত্র একই স্থানে নামানো সংগত নয় ভেবে অর্ধেক রায়মঙ্গলে এবং বাকীটা উড়িষ্যার সমুদ্র সৈকতে অরন্যাঞ্চলের বুড়িবামালে খালাসের সিদ্ধান্ত হয়। বাঘা যতীনের উপর উড়িষ্যার বালেশ্বরে অস্ত্র গ্রহণ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব অর্পিত হয়। বাঘা যতীন বন্ধু পূর্ণদাসের কাছে অস্ত্র সংগ্রহ অভিযানে অংশগ্রহণের জন্য দুঃসাহসীদের মধ্য থেকে চারজন বীরযোদ্ধা বাছাই করে পাঠানোর অনুরোধ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের নব অধ্যায় রচনায় পূর্নচন্দ্র দাস তাঁর একান্ত সহচরদের মধ্য থেকে যে তিনজন বিশ্বস্ত বীর সেনানীকে পাঠিয়ে ছিলেন তারা সবাই মাদারীপুরের সন্তান- নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী ও মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত। ১৯১৫ সালের সেপ্টেম্বরের তারিখে বিপ্লবী নেতা যতীন্দ্রনাথ মুখার্জী (বাঘা যতীন) এবং তাঁর সহযোদ্ধা মাদারীপুরের মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত,  চিত্তরঞ্জন রায়চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তসহ কলকাতার জ্যোতিষকে নিয়ে ময়ূরভঞ্জ করদরাজ্যের উদলা মহকুমার জঙ্গলাবৃত মহলডিহা গ্রামে অস্ত্র খালাসের উদ্দেশ্যে অবস্থান নেন। কিন্তু ফরাসি গোয়েন্দা সূত্রের সরবরাহকৃত খবর পেয়ে সমুদ্র বক্ষেই জার্মান জাহাজ আটক করে ইংরেজ নৌসেনারা। বিপ্লবীরা এ খবর জানতো না। কোলকাতার পুলিশ কমিশনার মি: টেগার্ট, বালেশ্বর সোর ব্যাটারির কমান্ডার মি: ফাদার ফোর্ড আর জিলা ম্যাজিস্ট্রেট মি: কিলভি বালেশ্বরের অকুস্থলে পৌঁছে যায় সদলবলে। বিপ্লবীরা বাঘা যতীনের নেতৃত্বে কিছুটা পিছুহটে বুড়িবালামের পাড়ে উই পাহাড়ের আড়ালে এক নিভৃত প্রান্তরের একটি জলাশয়ের পাশে বালির মধ্যে খোড়া পরিখায় অবস্থান নিয়ে টেগার্ট বাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে শুরু করে। এ অসম যুদ্ধে মাদারীপুরের সন্তান চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলে শহিদ হন। আহতবস্থায় বাঘা যতীনসহ মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। ১০ সেপ্টেম্বর কটক হাসপাতালে বাঘা যতীনের মৃত্যু হয়। বালেশ্বর ষড়যন্ত্র মামলায় রায়ে ১৯১৫ সালের ডিসেম্বর বালেশ্বর জেলে মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত ও নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের ফাঁসি হয়। বালেশ্বরের যুদ্ধ ছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য বীরত্বপূর্ণ বিপ্লবী ব্যঞ্জনাদীপ্ত ঘটনা। এ ঘটনার পরই মাদারীপুর ‘চিতোর অব বেঙ্গল’ খ্যাতিতে ভূষিত হয়। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

১৯২০ সালে মাদারীপুর মহকুমায় অনুশীলন ও যুগান্তর সমিতির কার্যাবলী বৃদ্ধি পায়। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে মাদারীপুরের সন্তোষ ব্যানার্জী পিতার জমিদারি ত্যাগ করে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দেন।

১৯২১ সালে বিলাসখান গ্রামের আশুতোষ কাহিলী, জীবন গুহঠাকুরতা প্রমুখ অনুশীলন নেতারা মাদারীপুরে একটি অনুশীলন শিক্ষাশ্রম প্রতিষ্ঠা করলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার চর্চা শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে মহাবিপ্লবী শান্তিসেনা'নায়ক পূর্ণচন্দ্রেদাসের নামে কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সন্ধ্যা নামক কাব্যগ্রন্থখানি উৎসর্গ করেন। 

১৯৩৮ সালে শরীয়তপুরের আঙ্গারিয়ার ডাকলুটের ঘটনায় নেজা বিদ্ধ হয়ে জ্যোতি নামে একজন বিপ্লবীর মৃত্যু হয়। এই ডাকলুটের অভিযোগে মাদারীপুরের অনুকূল চ্যাটার্জী, যোগেশ চ্যাটার্জী, প্রফুল্ল স্যানাল আন্দামান দ্বীপে নির্বাসিত হন। তাদের মুক্তির দাবীতে বৃহত্তর ফরিদপুরে আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনকারীরা রাজবাড়ীর দাদসী রেলষ্টেশন এবং কোটালিপাড়ার সেটেলমেন্ট অফিস পুড়িয়ে দেয়।

পূর্নচন্দ্র দাস পরিচালিত শান্তিসেনার ত্যাগী সদস্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন- কালী প্রসাদ ব্যানার্জী, খালিয়া; পঞ্চানন চক্রবর্তী, মাদারীপুর (২০ বছর জেল খেটেছেন); বিজয়নান্দ দত্ত, মাদারীপুর (১৫ বছর জেল খেটেছেন); ফণী মজুমদার, মাদারীপুর (১৮ বছর জেল খেটেছেন); সন্তোষ দত্ত, মাদারীপুর (১৪ বছর জেল খেটেছেন); বামন চক্রবর্তী, পাঠককান্দি (১৪ বছর জেল খেটেছেন); কালীপদ রায়চৌধুরী, আমগ্রাম (২০ বছর জেল খেটেছেন); আমলেন্দু দাশগুপ্ত, মাদারীপুর; নলিনী গুহ, মাদারীপুর; ইন্দুভূষণ মজুমদার, মাদারীপুর; ডা. প্রতাপ চন্দ্র গুহরায়, কেন্দুয়া; জীবন সরকার, মাদারীপুর; শরৎ গুহ, ঝাউদি; কল্যান নাগ, সাধু দাশগুপ্ত, বিনয় দাশগুপ্ত, বিনোদ দাশগুপ্ত, যতু দাশগুপ্ত, মাণিক দাশগুপ্ত, প্রণবানন্দ মহারাজ, অজিত দাশগুপ্ত, রমেন দাশগুপ্ত, সুরেন সাহা, সুরেশ ধর, শরৎ দাস, যজ্ঞেশ্বর দাস, অনুকূল চ্যাটার্জী প্রমুখ। মাদারীপুর সদর থানার খৈয়রভাঙ্গা গ্রামের দাশগুপ্ত পরিবার এবং তাদের অধিকাংশ আত্নীয় স্বজন ছিল বিপ্লবী দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থক। ১৯৪০ সালের মে মাসে নেতাজী সুভাষ বসু মাদারীপুর আসেন। স্কুলমাঠে তাঁর জনসভায় এ পরিবারের মেয়ে উমা দাশগুপ্ত ছিলেন স্বেচ্ছাসেবীকা দলের প্রধান। তাঁর উপর নেতাজীর আহার আপ্যায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। 

তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৫৫, ৫৬, ৫৭, ৫৮, ৫৯, ৬০)

Post a Comment

0 Comments