Ticker

7/recent/ticker-posts

খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মাদারীপুর | ইতিহাস অথবা ইতিকথা

 

খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে মাদারীপুর

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তুরস্কের খলিফার পরাজয়ের পর ব্রিটেন-ফ্রান্স মিত্রশক্তি খলিফাকে সিংহাসন চ্যুত করে তুরস্ককে বিভক্ত করার উদ্যোগ নেয়। সারা বিশ্বের মুসলমানগণ তাদের ধর্মীয়-রাজনৈতিক ঐতিহ্য খিলাফতের বিলুপ্তি ও তুরস্কের বিভক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।২১

মওলানা মুহাম্মদ আলী, এ.কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে ভারতের মুসলমান সম্প্রদায় ১৯১৯ সালে খিলাফত রক্ষা আন্দোলন শুরু করে। ১৯২০ সালে কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনে অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন একত্রে পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। করমচাঁদ গান্ধী খেলাফত আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে ১৯২১ সালে অসহযোগ আনদোলনের ডাক দেন। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইংরেজ সরকার প্রদত্ত উপাধি বর্জন, স্কুল কলেজ বর্জন, বিলাতী দ্রব্য বয়কট প্রভৃতি কার্যক্রম চলতে থাকে। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

ফরিদপুরের অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মাদারীপুরের হাজী শরীয়তুল্লাহর বংশধর আবু খালেদ মোহাম্মদ রশিদ উদ্দিন পীর বাদশা মিয়া। এ আন্দোলনে মাদারীপুর মহকুমার জনগণ ব্যপকভাবে সাড়া দেয়। ফরিদপুর জেলার মধ্যে মাদারীপুর মহকুমা ছিল সবচেয়ে রাজনীতি সচেতন এলাকা। বাহাদুরপুরের বাদশা মিয়া, মাদারীপুরের হাজী নয়ন শরীফ, স্বরমঙ্গলের মোজাহার মিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে মাদারীপুরের জনগণ অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনকে শক্তিশালী ও বেগবান করে তোলে। 

১৯২১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মাদারীপুরের খালিয়া গ্রামে খিলাফত অসহযোগের ডাকে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জ্যোতিষচন্দ্র রায় সভাপতিত্ব করেন। শরৎকুমার চৌধুরী এ সভায় তেজদীপ্ত বক্তৃতা করেন এবং পাঞ্জাবের সামরিক জুলুমের বর্ণনা দেন। শরৎ চৌধুরী অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে ওকালতি ত্যাগ করেন।২২

এ আন্দোলনে মুসলমানদের মধ্যে মাদারীপুরের আইনজীবী আলিম উদ্দিন আহম্মেদ, আবদুল জব্বার, দলিল উদ্দিন, মীর আবদুল মজিদ বিশেষ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মাদারীপুরে বিলেতি পন্য বর্জন ও দেশী খাদ্য ব্যবহার জনপ্রিয়তা লাভ করে। ‘আল্লাহু আকবর’ ‘বন্দে মাতরম’ ‘আলী ভাইদের জয়’ আন্দোলনের কর্মী ভলান্টিয়ারদের প্রভৃতি উচ্চকিত স্লোগানে মাদারীপুরের গ্রামগঞ্জ সরগরম হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার মাদারীপুরে দমন নীতি চালায়। মাদারীপুর থেকে হাজী নয়ন শরীফ, ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, কালকিনির খান সাহেব আলিম উদ্দিন আহম্মেদ প্রমুখ আন্দোলকারীকে গ্রেফতার করে। ১৯২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শিবচর থানার অন্তর্গত বাহাদুরপুর গ্রামের পীর বাদশা মিয়াকে খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলন করার অভিযোগে এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। তাকে কারাগারে নেয়ার সময় ৫০ হাজার লোক জেলখানার দ্বার পর্যন্ত তাঁর অনুসরণ করেছিলেন।২৩

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি কারাবরণ করেন।২৪ ১৯২১ সালের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে মাদারীপুর কংগ্রেস কমিটির সেক্রেটারি ও স্বরাজ্য সমিতির প্রেসিডেন্ট পূর্ণচন্দ্র দাস গ্রেফতার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল- তিনি মাদারীপুরে এক জনসভায় করাচীর প্রস্তাব ( জুলাই ১৯২১) পড়ে শুনিয়েছিলেন। স্বদেশী যুগেও তিনি অনেকবার অভিযুক্ত হন। সাড়ে পাঁচ বছর কারা অন্তরীণ থাকার পর মুক্তি পেলেও কিছুদিন পর আবার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর গ্রেফতারে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাকে জেলে নেয়ার সময় দুই হাজার শান্তিসেনা ও স্কুলের ছাত্র তাঁর অনুসরণ করে।২৫

১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাদারীপুর কংগ্রেস কমিটির সহকারী সেক্রেটারি নড়িয়ার প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা ডা. সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরীকেও খিলাফত অসহযোগ আনদোলনের দায়ে কারাবরণ করতে হয়।২৬ 

২৪ ডিসেম্বর হরতালের দিনে পুলিশ মাদারীপুরের প্রায় ২০০ জন রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেফতার করে। মাদারীপুর জেলে তাদের স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেক বন্দীকে ফরিদপুর জেলে প্রেরণ করা হয়। ফরিদপুরের মৌলবী তমিজউদদীন খান গান্ধীজীর আহ্বানে আইন ব্যবসা ছেড়ে কলকাতা থেকে ফরিদপুরে চলে আসেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ফরিদপুর জেলে পুরে রাখে। ফরিদপুর জেলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি ‘কালের পরীক্ষা ও আমার জীবনের দিনগুলি’ নামক আত্মজৈবনিক গ্রন্থে লিখেছেন ‘তখন মাদারীপুর ছিল আমাদের জেলার সবচেয়ে সচেতন এলাকা। সে সময়কার অসংখ্য কিশোর তরুণ তখন জেলে। এদের কাছে আসতে জেল কর্তার গলদঘর্ম হচ্ছিল।’

তবে ফরিদপুর জেলে প্রেরিত ১৬০ জন অসহযোগী বন্দী ‘ভবিষ্যতে আর এরূপ করবেন না’ বলে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্তিলাভ করেন।২৭

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

এ আন্দোলনের সফল নেতা হিসেবে তমিজউদদীন খান ১৯২৬ সালের এবং ১৯২৯ সালের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের নির্বাচনে মাদারীপুর-গোপালগঞ্জের আসন থেকে এসএলসি নির্বাচিত হন। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, রাজৈর থানার সেনদিয়া গ্রামের সন্তান সর্বভারতীয় রাজনীতির সিংহপুরুষ এবং ফরিদপুরের একচ্ছত্র কংগ্রেস নেতা অম্বিকাচরণ মজুমদার সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের মতো গান্ধীর সাথে দ্বিমত পোষণ করে খিলাফত- অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। এ কারণে ফরিদপুরের বার সমিতি অম্বিকাচরণ মজুমদারের সদস্য পদ বাতিল করে দেয়। তাঁকে অপমানও করা হয়। এ ঘটনার পর থেকে তিনি নীরবে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।২৮

খিলাফত অসহযোগ আন্দোলন যখন তুঙ্গে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি ইউ.পি গ্রাম চৌরিচৌরার পুলিশ স্টেশনে একটি মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয়। পুলিশ আন্দোলনকারী কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করে। গুলি ফুরিয়ে গেলে উত্তেজিত জনতার ধাওয়া খেয়ে তারা দৌড়ে পুলিশ স্টেশনে আশ্রয় নেয়। পুলিশের অত্যাচারে বিক্ষুব্ধ জনতা পুলিশ স্টেশনে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তাতে ২২ জন পুলিশ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়। এতে করমচাঁদ গান্ধী বিচলিত হন এবং অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করে দেন।২৯


তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৬৪, ৬৫)

Post a Comment

0 Comments