Ticker

7/recent/ticker-posts

মাদারীপুরে ভারত ছাড় আন্দোলন | মাদারীপুর প্রেক্ষাপটে

Varot char andolon

ভারত ছাড় আন্দোলন

১৯৪২ সালের আগস্ট ‘কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট’ বা ভারত ছাড় আন্দোলনে সারা ভারতবর্ষের মতো মাদারীপুর মহকুমাও উত্তাল হয়ে উঠে। আন্দোলন দমনে সরকার গুর্খা পুলিশ আমদানি করে। আগস্ট ছিল সারা ভারতে সাধারণ ধর্মঘট। আন্দোলনকারীরা এদিন সকাল বেলা মিছিল সহকারে এসে আদালত চত্ত্বরে প্রবেশের তিন দিকের পথেই পিকেটিং শুরু করে। ধর্মঘটে সাড়া দিয়ে সকলকে কোর্টকাছারি বর্জনের আহ্বান জানান হয়। নেটিভ মুন্সেফ আদালত চত্ত্বরে ঢুকতে চাইলে তাকে স্বদেশী পোশাক ধুতি পাঞ্জাবী পরে আসতে বলা হয়। প্রথমে তিনি বাসায় ফিরে যান। কিন্তু দ্বিতীয়বার এসে পিকেটারদের বাধার সম্মুখীন হলে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য ধমক দেন। পুলিশ অমনি পিকেটারদের উপর বেধড়ক লাঠি চার্জ শুরু করে। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

পুলিশের নির্মম লাঠিপেটায় রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত অহিংসবাদী কংগ্রেসী কর্মীরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে থেকে মার খায়। তবে স্কুলের ছাত্ররা টিএসআই বাহাউদ্দীনসহ ২/৩ জন পুলিশকে নাজেহাল করে। বাহাউদ্দীনকে তারা স্যাঁতসেঁতে শেওলা জমা কাদার স্কুল মাঠে ফেলে টানাটানি করে। পুলিশদের ইউনিফর্ম খুলে রাখা হয়। কালী বাড়ির নাটমন্দিরের মধ্যে দিয়ে সেগুলো পুড়িয়ে ফেলার বহ্ন্যুৎসব হয়। 

বিকেলে পিকেটারদের উপর পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে বিরাট জনসভা হয়। পরদিন ১০ আগস্ট একজন অফিসারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ মাদারীপুর স্কুলে প্রবেশ করে হেড মাস্টার শৈলেশ ঘোষের কাছে পুলিশকে হেনস্তা করার জন্য কৈফিয়ত চায় এবং পুলিশকে ইনসাল্টকারী ছাত্রদের নামের তালিকা দিতে বলে। জবাবে হেড স্যার বলেন, পুলিশের হেনস্তা করার ঘটনা তারা দেখেননি, শুনেছেন। স্কুলের নিজস্ব নিয়ম কানুনে দোষীদের বিচার হবে। ছাত্রদের তালিকা তৈরি করে পুলিশের হাতে দেয়া শিক্ষকদের কাজ নয়। তর্ক বির্তকের এক পর্যায়ে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ বেধে যায়। ছাত্ররা স্কুলের জানালা ভেঙ্গে লোহার রড বের করে পুলিশ পেটায়। শক্তি সঞ্চয় করে পুলিশ পাল্টা আঘাত হানে। ১১ আগস্ট পুলিশী হামলা ও নৃশংস বর্বরতার প্রতিবাদ সভা আহ্বান করা হয় নদী ভাঙনের পর স্থানান্তরিত দ্বিতীয় মিউনিসিপালিটির নতুন বাজারে। এটাই ছিল আগস্ট আন্দোলনে মাদারীপুরের সবচেয়ে গণজমায়েত। কিন্তু এ দিন কালীবাড়ি চত্ত্বরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির সমর্থনে কমিউনিস্ট পার্টিরও একটি পূর্ব নির্ধারিত মিটিং ছিল। সেখানে তারা জাপান-রোমান-জার্মানির বর্বরতার সচিত্র বুলেটিন ও নেতাজী সুভাষ বসুকে নিয়ে আঁকা বড় বড় ব্যাঙ্গাত্মক কার্টুন প্রদর্শনীর আয়োজন করে। কয়েকজন উৎসাহী কমিউনিস্ট কর্মী লাশকাটা ঘরের মোড়ে দাঁড়িয়ে চোঙ্গা ফুঁকিয়ে কোরাস স্বরে জনতাকে তাদের জনসভায় যোগদানের জন্য অবিরাম আহ্বান জানাতে থাকে। এতে কংগ্রেসের জনসভার কাজে বিঘ্ন ঘটে। প্রতিবাদ জানাতে গেলে উভয় দলের মধ্যে হাতাহাতি মারামারি বেঁধে যায়। কংগ্রেস কর্মী স্বরাজ, সোনা ও শিব নারায়ণের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের উপর আক্রমণ পরিচালিত হয়। কমিউনিস্ট কর্মী রণজিৎ রায়চৌধুরী প্রচন্ড মার খায়। মারের চোটে কমিউনিস্টরা পালিয়ে গেলেও উভয়ের সভাই পণ্ড হয়ে যায়। সভা না জমলেও কংগ্রেসের একটা বিরাট মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশ মিছিল থেকে মাদারীপুর মহকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য ও লেংড়া সরকারকে গ্রেফতার করে। মাদারীপুরে সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের প্রধান অংশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। তাদের শক্তি ও সাহস কম ছিল না। ওইদিন রাতেই কমিউনিস্টরা পুরান বাজারের টলঘরে দু'জন কংগ্রেস কর্মীকে ছুরিকাঘাত করে। শোনামন্দির গোপাল নামক এক ব্যক্তির পেটে ছুরি চালিয়ে নাড়িভুড়ি বের করে দেয়। কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেসের হানাহানিতে, আন্দোলনের মুখ্যধারার দ্বিধাবিভক্তিতে, অত্যাসন্ন করাল দুর্ভিক্ষের কর্কশ পদধ্বনিতে আগস্ট আন্দোলন ক্রমশ বেগ হারিয়ে তিথু হয়ে আসে। মাদারীপুরে ‘ভারত ছাড় আন্দোলন’ সর্বত্র অহিংস ছিল না। আন্দোলনকারীরা ভাঙ্গা থানা আক্রমণ করে জালিয়ে দেয় এবং দারোগ রোহিণী কুমার ঘোষসহ তিনজন কনস্টেবলকে হত্যা করে ভাসিয়ে দেয় নদীতে।৩০

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 


নিহত পুলিশের লাশ ভেসে এসে মহিষেরচর নদীর বাঁঁকে আটকে থাকে। এ আন্দোলনের ঢেউ লাগে পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ মহকুমাতেও। ২০ আগস্ট গোপালগঞ্জ মহকুমায় ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ শহরে জনসভা হয়। জনসভা শেষে একটি জঙ্গী মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। ১৮ সেপ্টেম্বর হরিণাহাটিতে, ২০ সেপ্টেম্বর বান্ধাবাড়িতে এবং ৩০ সেপ্টেম্বর সুয়াগ্রামে জনসভা হয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে কোটালীপাড়ার রাধাগঞ্জ এটেস্টেশন অফিস আক্রমণ করে কাগজপত্র ধ্বংস করা হয়।৩১

তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৬৬, ৬৭)

Post a Comment

0 Comments