Ticker

7/recent/ticker-posts

মাদারীপুরে রাজনৈতিক সংগঠন | ভারতীয় জাতীয় কংগেস

Madaripur a rajnoitik songothon

 ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কতিপয় জাতীয় নেতার উদ্দ্যোগে ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। ক্রমে এটি সম্প্রসারিত হয়ে বিশ শতকের গোড়ার দিকে একটি জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। বড়লাট রিপনের আমলে ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের আন্দোলনকালে প্রতীয়মান হয় যে, ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে প্রতিনিধিত্বশীল আলোচনার ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত রাজনীতিবিদদের প্রয়োজন একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন। এমন একটি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির উদ্দ্যোগ নেন একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ আই.সি.এস অফিসার এ.ও হিউম। তার উদ্দেশ্য ছিলো এমন একটি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উচ্চশ্রেনির ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসন সম্পর্কে তাদের ক্রমবর্ধমান অসন্তোশ প্রকাশ করতে পারে। এ উদ্দ্যোগকে স্বাগত জানান সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী যিনি ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান এসোসিয়েশন এবং ১৮৮৩ সালে ন্যাশনাল কনফারেন্স গঠন করেছিলেন।


হিউমের উদ্যোগের পিছনে বড়লাট ডাফরিনের সমর্থন ছিলো। কারন তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান যা ব্রিটিশেরঅনুগত বিরোধীদলহিসেবে কাজ করতে পারে। একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যারিষ্টার এবং ব্রিটিশ শাসনের উৎসাহী সমর্থক ডব্লিউ.সি ব্যানার্জীকে ১৮৮৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোম্বাইতে অনুষ্ঠেয় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্ধোধনী সম্মেলনের প্রথম সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। যে সকল নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি এই সংগঠনে যোগ দেন তাদের মধ্যে ছিলেন দাদাভাই নওরোজী, ফিরোজ শাহ মেহতা, বদরুদ্দিন তৈয়বজী এবং কে.টি তেলং। সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষিত ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার সৃষ্টি এবং নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। কেবল ফরিদপুর নয়; সর্বভারতীয় কংগ্রেসের ইতিহাসে রাজৈর থানার সেনদিয়া গ্রামের সন্তান অম্বিকাচরন মজুমদারের (১৮৫০-১৯২২) নাম ভাস্বর হয়ে থাকেবে।

১৮৮৩ সালে বঙ্গদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় রাজনৈতিক সম্মেলনে ধারাবাহিকতায় ১৮৮৫ সালের ২৮-৩১ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বোম্বাই অধিবেশনে ইংরেজ অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, দাদাভাই নওরোজী, সুরেন্দ্রনাথ বঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের প্রচেষ্ঠায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ছিলেন উমেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়।৩২


অম্বিকাচরন মজুমদার এই উভয় সম্মেলনেই যোগদান করেছিলেন। কংগ্রেসের জন্মের চার বছর পূর্বে ১৮৮১ সালে তিনি ফরিদপুর পিপলস এসোসসিয়েশন স্থাপন করেন। এটাই ছিল পুর্ব বঙ্গের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ১৮৮৬ সালে তিনি নিখিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কলকাতায় অনুষ্ঠিত য় সম্মেলনেও যোগদান করেন। ১৮৯৯ সালে নিখিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বর্ধমানে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

১৯১০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সম্মেলনেও তিনি সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৬ সালে অনুষ্ঠিত ৩২তম লাক্ষ্ণৌ অধিবেশনে নিখিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯১৭ সালে তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য (এমএলসি) নির্বাচিত হন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের প্রশ্নে গান্ধীর সাথে দ্বিমথ পোষন করায় রাজনীতি থেকে নির্বাসিত হন। 

আরও পড়ুন: 

১৯২১ সালে ফরিদপুর জেলার কংগ্রেসের নেতৃত্বে ছিলেন মাদারীপুরের সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, প্রমথ গুহ, সতীশ মজুমদার, যদুনাথ পাল, ভাঙ্গার শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরী, ফরিদপুরের তমিজদ্দিন খান (ফরিদপুরের কংগ্রেসের জেলা কমিটির সম্পাদক ছিলেন। ১৯৩০ সালে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন), লালমিয়া প্রমুখ। ১৯২৮ সালে ফরিদপুরে কংগ্রেস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন সুভাষচন্দ্র বসু। এ সময়ে মাদারীপুরের ফনি মজুমদার সুভাষ বসুর ব্যক্তিগত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৯ সালের লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারতের স্বাধীনতার প্রস্তাব গৃহীত হলে মাদারীপুরের অনেক সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী কংগ্রেসে যোগ দেন। ১৯৩০ সালে গান্ধীর নেতৃত্বে লবন সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে সারা ভারতে হাজার হাজার কংগ্রেসের নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। ফরিদপুর জেলায় প্রায় দু'হাজার লোক কারাবরন করে। মাদারীপুরের শান্তি সেন, পীর বাদশা মিয়া, হাজী নয়ন শরীফসহ অনেকে কারাবরন করেন। 

১৯৪০ সালের মে মাসে সুভাষচন্দ্র ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, মাদারীপুর ও ফরিদপুরে সফর করেন। ঢাকার সমাবেশ শেষে সুভাষচন্দ্র বসু মাদারীপুরে পৌছান। মাদারীপুর স্কুল মাঠে জনসভায় ফনি মজুমদারের পরিচালনায় দেড়শ'র বেশী নারী কর্মী তাঁকে গার্ড ওফ অনার প্রদান করে। মাদারীপুর সদর থানার খৈয়রভাঙ্গা গ্রামের দাশগুপ্ত পরিবার এবং তাদের অধিকাংশ আত্মীয়স্বজন ছিল বিপ্লবী দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক। স্কুল মাঠের জনসভায় এ পরিবারের মেয়ে উমা দাশগুপ্ত ছিলেন সেচ্ছাসেবিকা দলের প্রধান। তিনি ছিলেন একমাত্র মহিলা যার উপর নেতাজীর আহার আপ্যায়নের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। মাদারীপুরে অবস্থান শেষে নেতাজী ফরিদপুরে যান এবং একটি জনসভায় ভাষন দেন।৩৩

১৯৪২ সালে গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু হয়। এ আন্দোলনেও মাদারীপুরের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।

মাদারীপুরের কংগ্রেসের রাজনীতিতে কালকিনি থানার গোপালপুর গ্রামের কাজী পরিবারের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। কাজী আবদুল আজিজ স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। বিলেতী পন্যবর্জন আন্দোলনে তিনি পুলিশ কতৃক নির্যাতিত হন। তাঁর দু'পুত্র কাজী লুৎফর রহমান ও কাজী হাবিবুর রহমান কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৪ সালে করমচাঁদ গান্ধী মাদারীপুর এলে তার জনসভায় কাজী লুৎফর রহমান ভাষন দেন। গান্ধীজী মাদারীপুর লঞ্চঘাট নেমে লংমার্চে পায়ে হেটে চরমুগরিয়া বন্দরে যান। 

অম্বিকাচরন মজুমদার জাতীয় কংগ্রেসের একজন বড় মাপের কেন্দ্রীয় নেতা হলেও মূলত তাঁর রাজনীতির বিচরন ছিল ফরিদপুর জেলা শহর। মাদারীপুর মহকুমা কংগ্রেসের সম্পাদক ছিলেন সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য। নেতৃস্থানীয় অন্যদের মধ্যে ছিলেন লেংড়া সরকার, আবদুস ছত্তার মুন্সী, দলিল উদ্দিন আহম্মেদ উকিল (১), খান সাহেব আলিমউদ্দিন আহম্মেদ, নয়ন শরীফ সরকার, শামসুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী (বাদশা মিয়া) প্রমুখ। মোজাহার মুন্সী এককালে কৃষক প্রজা সমিতি করলেও তিনিও পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিজয়ের পর মুসলমানদের মধ্যে প্রায় সকলেই মুসলিম লীগে যোগ দেন। মকবুল খা, সুফী জোনাবালী এবং আবদুল সত্তার মুন্সী পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরও কংগ্রেসে থেকে যান। সুফী জোনাবালী পশ্চিম রাজৈরের লোক হলেও অধিকাংশ সময় মাদারীপুর শহরেই থাকতেন। তিনি ভদ্র, শীলিত, বিনয়ী ও স্বল্পভাষী স্বভাবের লোক ছিলেন। খদ্দরের সাদা পাঞ্জাবী, সাদা লুঙ্গী এবং মাথায় খেলাফত টুপি পড়তেন। মুসলমান হয়ে কংগ্রেস দল করার অপরাধে মীরজাফর আখ্যা দিয়ে একদিন মুসলিম লীগ সমর্থক কতিপয় যুবক তাঁকে তাড়া করে। আক্রান্ত হয়ে দৌড়ে তৎকালে নির্মানধীন পৌরভবনের সামনে মোক্তার মোস্তফা কাজীর কাঠের দোতলায় উঠে নিগৃহ থেকে রক্ষা পান। কিন্তু একদল অর্বাচীনের কাছে অপদস্ত হয়ে সেই যে তিনি মাদারীপুর ছাড়লেন আর কখনও ফিরে আসেননি। মনের কষ্টে মুসলমানদের সাধের পাকিস্তান ছেড়ে চলে যান ভারতে। সেখানেই তার মৃত্যু এবং পশ্চিমবঙ্গের গোবরায় তাঁর সমাধি হয়েছে।


তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৬৭, ৬৮,৬৯)

Post a Comment

0 Comments