Ticker

7/recent/ticker-posts

অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ | মাদারীপুর প্রেক্ষাপটে

all india muslim league


 অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ 

মুসলিম লীগ ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত একটি রাজনৈতিক দল। শুরুতে আগাখান এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ কতৃক পরিচালিত এ দলটি মুসলিম জাতীয়তাবাদের পক্ষে জনসমর্থন তৈরিতে এবং অবশেষে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করে। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পটভূমি ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় হতে চিহ্নিত করা যেতে পারে। সরকারের সঙ্গের ক্ষমতার অংশীদারিত্ব এবং ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে অনুপ্রানিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হিন্দু সম্ভ্রান্ত শ্রেনি কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিল। মুসলিম সমাজের সর্বোচ্চ সম্মানিত নেতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থে ভারতীয় মুসলমানদের কংগ্রেসে যোগ না দিতে হুশিয়ার করে দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, একটি পশ্চাদপদ জাতি হিসেবে মুসলমানগণ ব্রিটিশের প্রতি বিরোধিতার পরিবর্তে অনুগত্যের মাধ্যমেই অধিকতর সুযোগ সুবিধা পেতে পারে। মুসলমান জনগোষ্ঠীর মাঝে ইংরেজী শিক্ষা জনপ্রিয় করে তোলার জন্য তিনি তাঁর অনুসারীদের সর্বশক্তি নিয়োগের নির্দেশ দেন। এভাবে 'মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি' (১৮৬৩), 'সেন্ট্রাল মোহামেডান এসোসিয়েশন' (১৮৭৭), 'ইউনাইটেড ইন্ডিয়ান পেট্রিয়টিক অ্যাসোসিয়েশন' (১৮৮৮), এবং অন্যান্য অনেক স্থানীয় আঞ্জমান গড়ে উঠে। এগুলি রাজনীতির চেয়ে সামাজিক পূর্নজাগরণমূলক কাজে অধিকতর সক্রিয় ছিল। ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমান সম্প্রদায়ের শিক্ষাসংক্রান্ত সমস্যা সমূহ আলোচনার জন্য এবং সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রচার করার জন্য বছরে একবার অনানুষ্ঠানিকভাবে সভায় মিলিত হত। কংগ্রেসের পৃষ্ঠপোষকতায় বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) বিরুদ্ধে পরিচালিত বিক্ষোভ এবং স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এমনি এক সভা (সর্বভারতীয় মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন)  ১৯০৬ সালে ঢাকার শাহবাগে অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় মুসলমানদের'স্বার্থ সংরক্ষনের উদ্দেশ্যে ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ এ সভায় একটি রাজনৈতিক মঞ্চ গঠনের প্রস্তাব করেন। সভার সভাপতি নওয়াব ভিকার-উল-মূলক প্রস্তাবটি সমর্থন করেন এবং এভাবে সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারত সরকারের প্রতি আনুগত্যের কাঠামোর মধ্যে থেকে মুসলিম লীগ তেমন কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রনয়ন করেনি। ১৯৩৫ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নেতৃত্ব গ্রহন না করা পর্যন্ত সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে অর্থবহ ছিল না। 

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

১৯৩৭ সালে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ.কে ফজলুল হক মুসলিম লীগে যোগদান করেন এর ফলে মন্ত্রীসভা কার্যত মুসলিম লীগের মন্ত্রীসভায় পরিনত হয়। হকের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ব্যবহার করে বাংলাকে মুসলিম লীগের দুর্গে পরিনত করা হয়। বাংলার মুসলমানদের নেতা হিসেবে ফজলুল হক মুসলিম লীগের মঞ্চ থেকে উপমাহাদেশের মুসলমানদের জন্য 'স্বাধীন আবাসভূমির' দাবী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বাংলার মুসলিম জনমতের উপর ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের প্রচন্ড প্রভাব ছিল। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬-এর মধ্যে মুসলিম লীগ একটি যথার্থ জাতীয় সংগঠনে পরিণত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিম নেতৃত্বে মুসলিম লীগ এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বাংলার মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৭ আসনের মধ্যে ১১০ টি আসন অর্জন করেন।

১৯৪৭ এর ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা অর্জিত হলে মুসলিম লীগ মুসলমানদের প্রায় সকলের সংগঠনে পরিনত হয়। ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে মুসলিম নেতাদের এক অধিবেশনে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও মাদারীপুর মহকুমায় তার সাংগাঠনিক মজবুতি পেতে যথেষ্ট অপেক্ষা করতে হয়েছে। এমনকি ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগকালেও কংগ্রেস ছিল মাদারীপুরের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। তৎকালীন মাদারীপুর মহকুমার এসডিও আবু তাহেরের নেতৃত্বে প্রশাসন ও সকল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কমিটিতে কংগ্রেসের নেতাদেরই প্রধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৪ আগষ্টে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মিছিল সংখ্যাধিক্য কংগ্রেস কর্মীদের নিয়ন্ত্রনে চলে যায় এবং তারা উদযাপন কমিটির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের বাহিরে বিভিন্ন কংগ্রেসী শ্লোগান উচ্চারন করে। কলকাতা থেকে স্টিমার বোঝাই কংগ্রেস-কর্মী এনে শক্তি সমাবেশ করে। বিকেল টায় পুরান বাজার থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তান গণমিছিলে পূর্ব নির্ধারিত 'নারায়ে তকবির-আল্লাহু আকবর' শ্লোগান অনুচ্চারিত থাকায় মিছিলের মধ্যেই কার্যকর প্রতিবাদে অসমর্থ হয়ে স্বল্প সংখ্যক মুসলিম লীগপন্থী ছাত্র যুবকেরা মিছিল শেষে শহরে স্বহস্তে নির্মিত তোরন ও সাজসজ্জা তছনছ করে অক্ষম ক্ষোভের প্রকাশ ঘটায়। মাদারীপুরের যে সব মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম খান সাহেব আলিমদ্দিন আহম্মেদ, নয়ন শরীফ সরকার, শামসুদ্দিন আহম্মেদ চৌধুরী (বাদশা মিয়া), মৌলভী আচমত আলী খান, মোতাহার উদ্দিন আহমেদ, মোজাহার মুন্সী, আবদুল খালেক তালুকদার, দলিলউদ্দিন আহম্মেদ(২), এসকান্দার আলী খান, আদেলউদ্দিন আহমদ, আবদুল জব্বার মুন্সী, আবদুল হাকিম মিয়া, সৈয়দ নুরুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, কোটিলা সরদার, রশিদ খাঁ, কাদের সর্দার, কাসেম সর্দার, বাছের হাওলাদার, জব্বার হাওলাদার, লালমিয়া, হাবিবুর রহমান চান, মোমিনউদ্দিন উকিল, মীর আবদুল মজিদ, আতিকুর রহমান, মজনু মিয়া, মোখলেছ খান, ফজলু মুন্সী, খন্দকার আবদুল হামিদ, সামসুল হক প্রমুখ।

সম্পর্কিত আর্টিকেল : 

১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট রাত ১২ টা মিনিটে হ্যাজাক ও হাউই বাজির তুবড়ির আলোয় জনাবিশেক নেতাকর্মী ও সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের উপস্থিতিতে মাদারীপুরে আনুষ্ঠানিক ভাবে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন মহকুমা মুসলিম লীগ প্রধান খান সাহেব আলিমউদ্দিন আহম্মেদ। পাকিস্তানোত্তরকালে মাদারীপুর মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন এসকান্দার আলী খান, মৌলভী আচমত আলী খান, খন্দকার আবদুল হামিদ প্রমুখ। খন্দকার আবদুল হামিদ ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে পাকিস্তানের দাবিতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মাদারীপুরের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে এসকান্দার আলী খান, আবদুল আজিজ মুন্সী, ছাত্রনেতা আবদুল হামিদ যোগ দিয়েছিলেন। 

রাজৈর থানার পূর্ব স্বরমঙ্গল গ্রামের মুন্সী মোজাহারুল হক (১৮৯৮-১৯৭৮ খ্রিঃ) অসহযোগ আন্দোলনে কংগ্রেস করলেও পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং কিছুকাল মুসলিম লীগ, মাদারীপুর মহকুমা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি মাদারীপুরের লঞ্চ ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর লঞ্চের নাম ছিল পাঞ্জেগানা।

এসকান্দার আলী খান (১.১২.১৯০১-২৪.৭.১৯৮৩) মাদারীপুর থানার খাগদী গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। একজন সরকারী চাকরিজীবী হিসেবে বহুকাল প্রবাস জীবন কাটিয়ে পরে মুসলীম লীগের রাজনীতিতে যোগ দেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দলাদলির সুবাধে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পক্ষপাত দুষ্ট আচরনের ফলশ্রুতিতে ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মাদারীপুরের প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিক খান সাহেব আলিমউদ্দিন আহম্মেদের পরিবর্তে তিনি মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মাদারীপুর থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন।

আবদুল হামিদ খন্দকার মাদারীপুর থানার এওজ গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৪২ সালে তিনি মাদারীপুর মহকুমার ছাত্র ফেডারেশনের সেক্রেটারি ছিলেন। ১৯৪৪ সালে মাদারীপুর মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে মাদারীপুর মহকুমায় মুসলিম লীগ মনোনীত প্রার্থীর নির্বাচন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে পাকিস্তানের দাবীতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মাদারীপুরের প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে ছাত্রনেতা খন্দকার আবদুল হামিদ যোগ দিয়েছিলেন। 

সৈয়দ উদ্দিন আহমেদ (১৯০৭-১৯৮০খ্রিঃ) মাদারীপুর থানার পেয়ারপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। একজন মোক্তার হিসেবে মাদারীপুর বার এসোসিয়েশনে আইন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। মাদারীপুর মহকুমা মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন। তিনি একাদিক্রমে ত্রিশ বছরের বেশী কুনিয়া ইউনিয়ন বোর্ড এবং পরবর্তীতে পেয়ারপুর ইউনিয়ন বোর্ডের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৭০, ৭১, ৭২)

Post a Comment

0 Comments