Ticker

7/recent/ticker-posts

আওয়ামী লীগের সূচনালগ্নের ইতিহাস | আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ | মাদারীপুর প্রেক্ষিতঃ

 

Awami League

"আওয়ামী মুসলীম লীগ"

মুসলীম লীগ সরকারের অন্যায় প্রতিরোধে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন ঢাকায় টিকাতুলীর কেএম দাস লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবিরের উদ্যোগে বঙ্গীয় প্রাদেশীক মুসলিম লীগের এক বিশেষ অংশের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হোসেনের নেতৃত্বাধীন নেতা কর্মীদের এক কনভেনশনে অনুষ্ঠিত হয়। কনভেনশনের প্রথম দিন ২৩ জুন 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' গঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতি হন আতাউর রহমান খান, শাখাওয়াত হোসেন ও আলী আহমদ। টাঙ্গাইলে শামসুল হক সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ মুজিবর রহমান (জেলে অন্তরীন অবস্থায়), খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ.কে রফিকুল হোসেনকে যুগ্ম সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পুরো পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সংগঠনটির নাম রাখা হয় 'নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ'। এর সভাপতি হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর 'মুকুল' প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর তিনি সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

রিলেটেড আর্টিকেল: 

১৯৫০ সালের ২১-২৩ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত দলের তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চা ও অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দলের নাম থেকে 'মুসলিম' নামটি বাদ দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলসমূহের জাতীয় কনভেনশনে শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রথম ছয়দফা কর্মসূচি পেশ করেন। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয়দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচী গৃহীত হয়। ছয়দফা কর্মসূচি প্রচারিত হলে দেশের ব্যপক জনসাধারনের সমর্থন মেলে। এরপর দেশের প্রতি মহকুমা, থানা ও গ্রামেগঞ্জে  ‍স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে উঠতে থাকে। মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের প্রক্রিয়ায় মাদারীপুরের  সক্রিয় আংশগ্রহন ছিল। মু.মতিয়ার রহমান বলেন- "মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নতুন ব্যুহ রচনার কাজ আবার নতুন করে শুরু হলো। হামিদ ভাই শেখ শেখ মুজিব ছাত্রলীগের এক অফিস খুললেন মিলন সিনেমা হলের উত্তর পাশে রাস্তার উল্টো দিকে মহকুমা সংগঠন গড়ার জন্য। ছাত্ররা তখনও রাজনীতি সচেতন নয়; সংগঠিত তো নয়ই। মফস্বলের স্কুলগুলোর ভগ্নদশা। ছাত্ররা নির্জীব, নিষ্প্রান। তাই নাজিমউদ্দিন কলেজের এবং ইউআই স্কুলের স্থানীয় কিছু ছাত্রের আনাগোনা চলছে। তখনো মহকুমা ছাত্রলীগের কমিটি নির্বাচনের কাজ শুরু হয়নি। এ অবস্থায় মুসলিম লীগ বিরোধী যুব ছাত্র কর্মীদের সম্মেলন ডাকা হয়েছে ঢাকা। ২২, ২৩ এবং ২৪ জুন সম্মেলনে যোগদানের জন্য কলেজ থেকে চার এবং স্কুল থেকে চার ছাত্র প্রতিনিধি মনোনীত হলো ছাত্রলীগ অফিসে আলোচনায় সংলাপে। কলেজের চার সদস্য- করম আলী সিং, আবদুস সাত্তার ফকির, মোখলেছুর রহমান এবং আমি। স্কুলের চার সদস্য হলো আব্দুল ওহাব মজনু, মোঃ রফিক আজাহার এবং আবদুল হাই। এদের তিনজনই মহিষেরচরের। মোখলেছ , মজনু এবং আমি ইকবাল পাঠাগারের এবং আমরা তিনজন হরিহরাত্মা। 

হামিদ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমাদের যাত্রা শুরু হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে লঞ্চে ২০ জুন। সুরেশ্বর থেকে রাতে উঠলাম মিকসড স্টিমারে। পরদিন সকালে নারায়নগঞ্জে। সেখান থেকে বাসে ভিক্টোরিয়া পার্ক। হেঁটে হাজির হলাম সলিমুল্লাহ মেডিকেল স্কুলে। সেখানেই আমদের অবস্থানের আস্তানা। স্টিমারে দেখা টুনু মান্নান এবং আতিকের সাথে। আচমত আলী খান তাদের পাঠিয়েছে কর্মী সম্মেলনের হালচাল এবং ফলাফল দেখার জন্য। যদিও তাদের সাথে তিনদিনের কোনদিনই দেখা হয়নি।...

বারান্দায় বালতিতে পানি দেয়া হলো। প্রক্ষালন পর্ব শেষে কাপড় জামা পালটিয়ে গেলাম বাবু বাজারের মাথায় ও আরমানিটোলা মাঠের দক্ষিনে আলহেরা হোটেলে। নাস্তা খেলাম হাফপ্লেট সুগন্ধি অথচ শুকনো বিরিয়ানী এবং এক কাপ চা পাঁচ পয়সায়। সেখান থেকে হেঁটে ১৫০ নম্বর মোগলটুলী ছাত্রলীগ অফিসে। স্বল্প পরিসরের কক্ষ। আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। পাকা মেঝেতে ফরাস বিছানো, তাতেই বসা। দেয়াল ঘেষে একটা হাতলওয়ালা বেঞ্চ। তাতে বসা জনাপাচেক। ফরাসে বসা জনাতিরিশেক ছাত্র যুবক। সভা আরম্ভ হয়ে গেছে। ছোট্ট একটা রঙ চটা টেবিল আশ্রয় করে একজন দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন।.. মাদারীপুর ছাড়া অন্য কোনো মহকুমা বা জেলা থেকে আটজন ছাত্র এ সভায় উপস্থিত ছিল বলে মনে হয় না। কেননা, তাহলে এ ক্ষুদ্র কক্ষে স্থান সাংকুলান সম্ভব হতো না।'৪৫

২৩ জুন দুপুরের পর কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান কাজী বশির সাহেবের টিকাতুলির বাড়ি রোজ গার্ডেনে। ২৪ জুন বিকেলে আরমানিটোলা মাঠে জনসভা হয়। মুসলিম লীগের গুন্ডারা জনসভায় হাঙ্গামা করে। এ বছরই দত্তপাড়ার সামসুদ্দিন আহমদ চৌধুরী (বাদশা মিয়া) কে কনভেনর করে মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি এডহক কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে মৌলভী আচমত আলী খান, আবদুল হামিদ খন্দকার ও সিরাজ সাহেব ছিলেন। 

নজরদারি পুলিশের এক গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ১৯৫২ সালের ০৬ আগষ্ট রাতে মাদারীপুর শহরে মৌলবী আচমত আলী খান মোক্তারের বাসভবনে শেখ মুজিবর রহমানের উপস্থিতিতে এবং নুরুল হকের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। মৌলভী আচমত আলী খান ছিলেন মাদারীপুর মহকুমা মুসলিম আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মাদারীপুর মহকুমা মুসলিম আওয়ামী লীগের প্রথম কার্যকরী কমিটি গঠিত হয় খাগদী গ্রামের জিন্নাত খানের বাড়ীতে। তখন মুসলিম লীগের গুন্ডামির ভয়ে মাদারীপুর শহরে সভা করার অবস্থা ও সাহস ছিল না। উক্ত সভাতেও শেখ মুজিবর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

১৯৫২ সালে পুনর্গঠিত মাদারীপুর মহকুমা কার্যকরী কমিটিতে সভাপতি ছিলেন চৌধুরী শামসুদ্দিন ওরফে বাদশা মিয়া এবং সেক্রেটারী ছিলেন আচমত আলী খান। জন সভাপতির মধ্যে অন্যতম ছিলেন দলিল উদ্দিন আহমদ বিএল। জয়েন্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন সৈয়দ শামসুল হক মোক্তার এবং মান্নান ওরফে টুনু মান্নান এবং এসিসটেন্ট সেক্রেটারি পদে রফিউদ্দিন আহমদ ও আবদুর রশিদ (মাদারীপুর শহরের ঘড়ি মেরামতকারী)। অফিস সেক্রেটারি ছিলেন খন্দকার আবদুল হামিদ। ট্রেজারার ছিলেন মোঃ আবদুল্লা। উক্ত কমিটিতে সদস্য হিসেবে চৌধুরী শফিউদ্দিন আহমদ, আবদুস সাত্তার ও সজুদ্দিন মোক্তারের নাম ছিল। একটি বর্ণনা মতে, ১৯৫৫ সালে মুসলিম আওয়ামী লীগের নাম হতে মুসলিম শব্দটি বাদ দিলে খন্দকার আবদুল হামিদ ও সজুদ্দিন মোক্তার মুসলীম লীগে প্রত্যাবর্তন করেন। সভায় আবদুল লতিফ হাওলাদার এবং মোহাম্মদ আবদুল্লাহ শেখ লিখিত স্টেটমেন্টের মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। সভা শেষে শেখ মুজিবর রহমান ওই রাতেই তরপাশা মেইলে ঢাকার উদ্দেশ্যে মাদারীপুর ত্যাগ করেন।৪৬


১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনের সূচনা লগ্নেই আওয়ামী লীগের মাদারীপুর মহকুমা কমিটি সভাপতি ও সেক্রেটারি পদে যথাক্রমে মৌলভী আচমত আলী খান ও আবদুল মন্নান মিয়া ওরফে টুনু মান্নানকে বহাল রেখে পুনর্গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগের মাদারীপুর মহকুমা কমিটিতে মৌলভী আচমত আলী খান সভাপতি, নুরুল হক মোক্তার, আমিনুল ইসলাম দানেশ ও এড. আমজাদ হোসেন খান সহসভাপতি ছিলেন। টুনু মান্নান ছিলেন সেক্রেটারি।৪৭

জন্মলগ্ন থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত যারা মাদারীপুর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম চৌধুরী শামসুদ্দিন ওরফে বাদশা মিয়া (মৃত্যু-১৯৬৩), মৌলভী আচমত আলী খান, এ্যাড. আদেল উদ্দিন হাওলাদার, আবদুল মান্নান মিয়া ওরফে টুনু মান্নান, ডা. গোলাম মাওলা (মৃত্যু-১৯৬৬), ডা. আবুল কাশেম, এ্যাড. আমজাদ হোসেন খান, আবদুল মান্নান শিকদার, মমিন উদ্দিন আহমদ, মীর আবদুল মজিদ, আব্দুস সাত্তার শিকদার, মকবুল হোসেন ভূঁইয়া, আবুল ফজল উকিল, আবদুল আজিজ মুন্সী প্রমুখ উল্লেখাযোগ্য। ফনী মজুমদার ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।

তথ্যসূত্র : “মুক্তিযুদ্ধে মাদারীপুর”, লেখক—বেনজীর আহম্মদ টিপু, সার্বিক সাহিত্য প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ—আগস্ট ২০১৪, পৃষ্ঠা—(৭৭, ৭৮, ৭৯, ৮০)

Post a Comment

0 Comments